আমার চো‌খে চু‌রিহাট্টা

‌সে‌দিন ফেব্রয়া‌রির ২০ তা‌রিখ, সময় রাত ১০টা। আ‌মি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যাল‌য়ের
বু‌য়েটের আহসান উল্লাহ হ‌লে খাবার ডে‌লিভা‌রি ক‌রে সাই‌কেল ঘুরি‌য়ে আবার না‌জিরা বাজার যা‌চ্ছিলাম, বক‌শিবাজার সিগন্যাল পাড় হ‌তেই ১০:১৮ তে আ‌রেকটা অর্ডার এ‌লে‌া, সাই‌কেল সাইড করলাম সি‌পি ফাইভ স্টা‌রের সাম‌নে, প্যা‌ন্টের ডান প‌কেট থে‌কে টুট টুট শব্দ করে বে‌জে চলা মোবাইল‌টি বের করলাম, দেখলাম জেলখানার ঢা‌লে "ওল্ড টাউন" রেস্টু‌রেন্ট না‌মের এক‌টি চাইনি‌জের অর্ডার এ‌সে‌ছে। অর্ডারটা এক‌সেপ্ট ক‌রে সি‌পি ফাইভ স্টারের উ‌ল্টো দি‌কে ‌রাস্তা প‌ার হ‌য়ে হে‌লিকন গা‌র্ডেন চাইনি‌জের সাম‌নে গি‌য়ে দা‌ড়ি‌য়ে কাস্টমার‌কে কল করলাম
ঃ হ্যা‌লো ভাইয়া পাঠাও থে‌কে বল‌ছি
ঃ জ্বি, বলুন
ঃ আপনার অর্ডারটা কি কনফার্ম ?
ঃ হ্যা কনফার্ম
ঃ খাবারটা কোথায় নি‌য়ে আসব ?
ঃ বেচারাম দেউরী, নান্না বি‌রিয়া‌নির পা‌শের গ‌ল্লি‌তে নুর বক্স লেন
ঃ আচ্ছা ঠিক আ‌ছে ভাইয়া, থ্যাংক ইউ
কাস্টমা‌রের সা‌থে কথা ব‌লেই ভাবলাম ওল্ড টাউন তো খাবার তৈ‌রি কর‌তে অ‌নেক সময় নেয় তাই আ‌গে থে‌কে কল দি‌য়ে খাবারটা তৈ‌রি কর‌তে ব‌লি তাহ‌লে আ‌মি বক‌শিবাজার থে‌কে জেলখানার সাম‌নে যে‌তে যে‌তে খাবারটা তৈ‌রি হ‌য়ে যা‌বে বা সময়টা কম লাগ‌বে। এই ভে‌বেই কল করলাম রেস্টু‌রে‌ন্টের নাম্বা‌রে, প্রথমবার ধরলনা, দ্বিতীয়বার ধরলনা, তৃতীয় বারও ধরলনা। ফোন দি‌তে দি‌য়ে চ‌লে এ‌সে‌ছি বদরু‌ন্নেসা ক‌লে‌জের সাম‌নে। তারপর ফোন না ধরায় বিরক্ত হ‌য়ে সাই‌কেল চা‌লি‌য়েই চ‌লে গেলাম ওই চাই‌নি‌জে। ওল্ড টাউ‌নের গেট এর উ‌ল্টোদি‌কে একটা দোকা‌নের কে‌চি গেটে সাই‌কেল শিকল দি‌য়ে তালা মে‌রে গেলাম চাই‌নি‌জের ভিত‌রে
ঃ ভাই, একটা অর্ডার নেন
ঃ ব‌লেন
ঃ আচ্ছা আপনা‌দের ৩বার কল করলাম, ধর‌লেন না যে ?
ঃ কোন নাম্বা‌রে কল দি‌সেন ?
ঃ গ্রা‌মীন টায়
ঃ লা‌স্টে কত ?
ঃ আটানব্বই
ঃ হয়ত ব্যাস্ত ছিলাম তাই ধর‌তে পা‌রি নাই।
ঃ য‌দি রেস্টু‌রে‌ন্টে ফোন দি‌য়ে আপনা‌দের না পাই তাহ‌লে ফোন রা‌খেন কি জন্য ? মোবাইল ফে‌লে দেন (বিরক্ত হ‌য়েই বললাম)
আমার কথা শু‌নে একটু র‌াগ্বা‌নিত হ‌য়ে বলল
‌ঃ কি অর্ডার ?
ঃ একটা চি‌কেন ফ্রাইড রাইস
ঃ অ্যাপ এ দাম কত লেখা ?
ঃ ১৬০ টাকা
ঃ ওকে, একটু ব‌সেন
আ‌মি সারা‌দিন সাই‌কেল চালা‌নোয় একটু ক্লান্ত ও চো‌খে মু‌খে ঘাম ছিল তাই ভাবলাম ওয়াসরু‌মে গি‌য়ে একটু ফ্রেশ হ‌য়ে নেই, তাই বিলটা পেইড ক‌র্চে‌লে গেলাম ওয়শরু‌মে।
‌বের হ‌য়ে দে‌খি খাবার রে‌ডি
ঃ এত জল‌দি ???
ঃ এটা রে‌ডি করা থা‌কে, স্যার
ঃ ওওহ
খাবারটা নি‌য়ে বা‌হির হ‌য়ে সাই‌কেল এর সাম‌নে গেলাম, কিন্তু হটাৎ ক‌রে নি‌চে নামর পর ম‌নের ভেতর কেমন জা‌নি লাগ‌ছিল। একটু লক্ষ্য ক‌রে দেখলাম আমার বয়সী কিছু ছে‌লে ও লোকজন জেলখানার দি‌কে দৌড়া‌চ্ছে। রাস্তায় একটু জ্যামও ছিল। এক আ‌ঙ্কেল রিক্সায় বসে বংশালের দি‌কে যা‌চ্ছি‌লেন জ্যাম এ উনার রিক্সাটাও আমার সামনে দা‌ড়ি‌য়ে ছিল, তো উ‌নি একজন‌কে ডে‌কে বল‌লেন কি হ‌য়ে‌ছে ?
‌সে বলল চকবাজা‌রে আগুন লাগ‌সে!!
তাৎক্ষ‌নিক আ‌মি আবার আ‌ড়ি পে‌তে শু‌নে একটু চম‌কে গেলাম, ভা‌লো ক‌রে দেখলাম যে কিছু ছে‌লে চকবাজা‌রের দি‌কে দৌড়া‌চ্ছে ও বল‌ছে আগুন লাগ‌সে, আগুন লাগ‌সে
আ‌মি ছোটকাল থেকেই চকবাজার বল‌তে জানতাম মাঝখা‌নে পাইকা‌রি মা‌র্কেট আর তার চারপা‌শে যে রাস্তা ওইটা, তাই ম‌নের ম‌ধ্যে ভাবলাম যে হয়ত ওই মা‌র্কে‌টেই আগুন লে‌গে‌ছে।
‌কৌতুহল বসত জেলখানার দি‌কে তাকালাম, সা‌থে সা‌থে শিউ‌রে উঠলাম, ভ‌য়ে আমার পু‌রো শ‌রীর একটা কাপু‌নি দি‌য়ে উঠল, শিউ‌রে উঠল আমার শ‌রী‌রের ডান হাত থে‌কে বাম হ‌া‌ত ও বু‌কের পশম।
‌অন্ধকা‌রে যখন একটা কে‌রো‌সি‌নের কু‌পি জ্বালা‌লে কু‌পির আগু‌নের ছায়াটা পিছ‌নের অন্ধকা‌রে যেইভা‌বে নড়া চড়া ক‌রে ঠিক সেইভা‌বে বিশাল এক আগু‌ন জেলখানার উপ‌রের আকা‌শে নড়া চড়া কর‌ছে
লাল হ‌য়ে গে‌ছে পু‌রে চকবাজা‌রের আকাশ, এই দে‌খে কিছুক্ষন স্তব্দ হ‌য়ে গেলাম, ক্ষ‌ণি‌কের ভাবনা ছে‌ড়ে চিন্তা করলাম দ্রুত খাবারটা ডে‌লিভা‌রি ক‌রে চকবাজার যাব। যেই ভাবনা সেই কাজ।
‌জেলখানার গে‌টের উ‌ল্টোপা‌শের ঢালু রাস্তা দি‌য়ে খাবারটা সাই‌‌কেলে ঝু‌লি‌য়ে সাই‌কেল নি‌য়ে সোজা আনন্দ বেকা‌রির পা‌শের সরু গ‌লি দি‌য়ে বেগমবাজা‌রের গ‌লি পাড় হ‌য়ে বে‌রি‌য়ে পরলাম বেচারাম দেউরী, নান্না বি‌রিয়ানীর সাম‌নের মো‌ড়ে গি‌য়ে কল দিলাম কাস্টমার‌কে
ঃ হ্যা‌লো ভাইয়া আ‌মিতো নুর বক্স লেন এর গ‌লির সাম‌নে
ঃ একটু ভিত‌রে ঢুকে দে‌খেন র‌নি টেইলার্স
ঃ হ্যা দে‌খে‌ছি
ঃ ওই টেইলার্সের পা‌শে দে‌খেন একটা বড় গেইট আ‌ছে ভিত‌রে ঢু‌কে ডান পা‌শের শে‌ষের বা‌ড়ি‌র তিন তলায় আ‌সেন
এতবড় ইন্ট্রুডাকশন শু‌নে মেজাজ খারাপ হ‌য়ে গেল, যাই হোক কাস্টমারের সা‌থে তো আর খারাপ বি‌হেব কর‌তে পা‌রি না। এই  ভাবতে ভাব‌তে ভিত‌রে গি‌য়ে তার কমান্ড মত ৩য় তলায় গি‌য়ে খাবারটা ডে‌লিভা‌রি ক‌রেই সাই‌কেল নি‌য়ে ছুটলাম চকবাজা‌রের দি‌কে, বেগমবাজা‌রের ম‌ধ্যে একটা পা‌নির পা‌ম্পের গ‌লি আ‌ছে ওইটা দি‌য়ে শর্টকাট নি‌য়ে চকবাজার বের হ‌চ্ছি প‌থিম‌ধ্যে দেখলাম একজন তরুন বয়‌সের ছে‌লে ও একজন ম‌হিলা মোলভীবাজা‌রের দি‌কে কান্না কর‌তে কর‌তে দৌ‌ড়ে যা‌চ্ছে। দে‌খেই বুঝলাম দুরঘটনাটা ভয়াবহ। চকবাজার বের হ‌য়েই দে‌খি সব দোকানাপাট বন্ধ, নেই  বিদ্যুৎ, আর উৎসুক জনতার প্রচন্ড ভিড়,
ভাবলাম আ‌মিও তো উৎসুক জনতার মত আগুন দেখ‌তে এ‌সে‌ছি, তা‌দের আর কি দোষ ?। তারাহু‌রো ক‌রে চকবাজা‌রের বটগা‌ছের নি‌চে ডাস্ট‌বি‌নের পা‌শে একটা দোকা‌নের সাম‌নের তারখাম্বার সা‌থে সাই‌কেলটা শিকল দি‌য়ে তালা মে‌রে দিলাম এক দৌড় শাহী মস‌জি‌দের দি‌কে। যে‌দিকে আগুন লে‌গে‌ছে সে‌দিকটা অনুমান ক‌রে চকবাজার থানার সাম‌নে দি‌য়ে যে গ‌লি আ‌ছে সে‌দি‌কে ঢুক‌তে নিলাম, দেখলাম পু‌লিশ বা‌শিঁ ফুঁ দি‌য়ে গ‌লির ভেতর থে‌কে উৎসুক জনতা‌কে ধাওয়া দি‌য়ে বের কর‌ছে। এসব দে‌খে আর ভি‌ড়ের ভিতর গেলাম না। গ‌লি থে‌কে বের হ‌য়ে একটু চিন্তা করে ম‌নে পড়ল এক‌দিন না আ‌মি এক কাস্টমার‌কে খাবার দি‌তে গিয়ে‌ছিলাম চু‌রিহাট্টা মস‌জি‌দের সাম‌নের ফা‌র্মে‌সি‌তে ? ওই‌দিন তো শাহী মস‌জি‌দের সা‌থের সরু একটা গ‌লি দি‌য়ে ওই গলি‌তে বের হয়ে‌ছিলাম, তো ওখান দি‌য়েই ঢুকব আ‌মি। এই ভে‌বেই জো‌ড়ে হাটা শুরু করলাম ওই দি‌কে, দেখলাম গ‌লির গেইট খোলাই আ‌ছে, ত‌বে কা‌রেন্ট নেই, দেখলাম ক‌য়েকজন লেবাররা গ‌লি‌তে ব‌সে প্লাস‌টি‌কের বড় বস্তা পাহাড়া দি‌চ্ছে, বুঝ‌তে পারলাম তারা গোডাউ‌নে বা দোক‌া‌নে এই বস্তাগুলা ঢুকা‌চ্ছিল কিন্তু আগুন লাগাতে ও লোকজ‌নের ভি‌ড়ের কার‌ণে তারা আর কাজ শেষ কর‌তে পা‌রে নাই, যে যেভা‌বে পে‌রে‌ছে দোকান বন্ধ ক‌রে দি‌য়ে‌ নিরাপদে চ‌লে গে‌ছে, তাই তারাও আগুন নেভার অ‌পেক্ষায় ব‌সে আ‌ছে। যাই হোক আ‌মি কোন রকম ওই গ‌লি‌ দি‌য়ে ঢু‌কে চু‌রিহাট্টার দি‌কে অগ্রসর হ‌তেই দেখলাম প্রচন্ড মানু‌ষের ভিড়, সব‌ার হা‌তেই মোবাইল, সবাই প‌শ্চিম দি‌কে (চু‌রিহাট্টা মস‌জি‌দ) আগুন এ জ্ব‌লে যাওয়ার দৃশ্য ভি‌ডিও কর‌ছে। 

কৌতুহল নি‌য়ে আমিও পশ্চিম দি‌কে তাকা‌লাম, চোখ কপা‌লে উ‌ঠে গেল আমার
চল‌বে.......